
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করার ক্ষেত্রে বিদেশিদের যদি কোনো ফর্মুলা বা পরামর্শ থাকে সেটা তারা নির্বাচন কমিশনকে দিতে পারে, সরকার ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এমন কথা বলা হয়েছে। সে ফর্মুলা দেওয়ার জায়গা যে নির্বাচন কমিশন সেটাও বলা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনে (ইসি) বিদেশিদের দফায় দফায় যাতায়াতের কারণে কৌতূহল তৈরি হয়েছে আদতে তারা কোনো ফর্মুলা দিচ্ছে কি না। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পশ্চিমা দেশ ও প্রতিবেশী দেশের গ্রহণযোগ্য নির্বাচনগুলো থেকে নানা উপাদান নিয়েছেন বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা। পিটার হাস পশ্চিমা অন্য রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বসে সেসব ফর্মুলা নিয়ে আলোচনাও করেছেন। সূত্রমতে, ফর্মুলা নিয়ে তিনি কাজ করছেন, নির্বাচন কমিশনেও যাচ্ছেন তিনি। তবে সেই ফর্মুলায় কী আছে সেটা জানা যায়নি। যদিও বিদেশিদের ফর্মুলা দেওয়ার বিষয়টি নির্বাচনের কমিশনের কেউ স্বীকার করেননি।
সর্বশেষ গত ১ আগস্ট নির্বাচন কমিশনে যান যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্র অক্টোবরে প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে। এর আগেও তিনি দুই দফা নির্বাচন কমিশনে গেছেন।
এরপর ২৭ আগস্ট যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার সারাহ কুক সিইসির সঙ্গে বৈঠক করেন। ১১ জুলাই নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে প্রথম দফায় বৈঠক করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক-নির্বাচনী অনুসন্ধানী দল। ১৮ জুলাই আবার বৈঠক করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক-নির্বাচনী কারিগরি ও আইনি দল। একইদিন কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন ইইউর রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি। ১ জুন সিইসির সঙ্গে বৈঠক করেন জাপানের রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরি।
২০২২ সালের ৩ জুলাই অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার (ওইসিডি) ১৪ জন প্রতিনিধি দলের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের বৈঠক হয়। প্রতিনিধিদলে ছিলেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসন, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলিও। এর আগে ওই বছরের ৮ জুন পিটার হাস নির্বাচন কমিশনে যান।
আগামী জাতীয় নির্বাচন, মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, রোহিঙ্গা ইস্যুতে গত বছরের মাঝামাঝি থেকে বিদেশিদের যাতায়াত বেড়েছে। নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাপানের তরফ থেকে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে চলতি বছর বিদেশিদের নির্বাচনকেন্দ্রিক তৎপরতা অনেক বেড়েছে। গত ২৪ মে যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসানীতিও ঘোষণা করেছে। সরকারি ও বিরোধী দল, নির্বাচন কমিশন (ইসি), প্রতিষ্ঠিত এনজিও, মানবাধিকারকর্মী, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী, বড় শিল্পপতি সবার কাছে ছোটাছুটি করছেন বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। দেশটির উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল ছাড়াও একাধিক প্রতিনিধিদল বিভিন্ন ইস্যুতে ঢাকা সফর করেছে। যুক্তরাষ্ট্র যে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করে, তাদের প্রায় সবাই এটা বলে গেছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন টানা তিনবারের সরকারও পাল্টা বার্তা দিচ্ছে যে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকার বদ্ধপরিকর। তবে সংবিধানের বাইরে গিয়ে কোনোভাবে নির্বাচনের সুযোগ নেই এটাও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে তাদের কোনো ফর্মুলা থাকলে নির্বাচন কমিশনে দিতে অনুরোধ করেছে ক্ষমতাসীনরা। সেসব ফর্মুলা আমলে নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছে সরকার ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায় থেকে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা দেশ রূপান্তরকে বলেন, নির্বাচন কমিশন ফর্মুলা দেওয়ার অন্যতম জায়গা। বিদেশিদের ফর্মুলা সেখানে যেতেও পারে। ফর্মুলায় বিতর্কমুক্ত নির্বাচনের কোনো উপাদান পেলে নিশ্চয়ই কমিশন সেটা আমলে নেবে।
তবুও থেমে নেই বিদেশিরা। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র সর্বত্রই আসা-যাওয়া করছে। নির্বাচন কমিশনে পিটার হাসসহ বিদেশি কূটনীতিক ও প্রতিনিধিদের যাতায়াত দেখে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহল বলছে, অতীতে নির্বাচন কেন্দ্র করে সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানে কূটনীতিকদের এত যাওয়া-আসা দেখা যায়নি।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিদেশিরা নির্বাচন কমিশনকে সুষ্ঠু নির্বাচনের ফর্মুলা দিতেই মূলত কমিশনে আসা-যাওয়া করছেন।
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সূত্রও জানায়, মূলত সুষ্ঠু নির্বাচনের বিভিন্ন পরামর্শ দিতে বেশি বেশি নির্বাচন কমিশনে যাতায়াত করছেন কূটনীতিকরা।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক মডেল ধরা হয় এমন নির্বাচন নিয়ে গবেষণা করছে কমিশন।
যদিও নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিদেশিদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক হয়েছে। সেখানে বিদেশিরা মূলত নির্বাচন পর্যবেক্ষক, পর্যবেক্ষণ, নির্বাচনের প্রস্তুতি ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করেছেন। কোন পন্থায় নির্বাচন হবে বা কোনো ফর্মুলা কিংবা কোনো পরামর্শ তাদের দেওয়ার সুযোগ নেই। তারা সেটি দেয়ওনি।’
নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে বিদেশিরা কোনো পরামর্শ বা ফর্মুলা দিচ্ছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমার মনে হয়, বিদেশিদের সঙ্গে বৈঠকে তারা ইসির কাছে জানতে চাচ্ছে এ পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন কী করবে। পরামর্শ বা ফর্মুলা দেওয়া ঠিক তাদের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না। নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু হয় সে দাবি তারা করতে পারে। নির্বাচন সুষ্ঠু করার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন কী করবে এটা তারা জানতে চাচ্ছে।’
নাম প্রকাশ না করে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ যারাই নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে আসছে, তাদের জানানো হচ্ছে, সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ সরকারের হাতে নেই। কিন্তু তাদের কোনো পরামর্শ থাকলে তা নির্বাচন কমিশনকে জানাতে পারে তারা।
দলের শীর্ষ পর্যায়ের এ নেতা আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া বাংলাদেশ সফরে এসে সরকারসংশ্লিষ্ট যত পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেছেন, সেখানে সবারই একই কথা ছিল সংবিধান সম্মতভাবে আগামী নির্বাচন হবে।
প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের একটি সূত্র ও কূটনীতি নিয়ে কাজ করেন আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় এক নেতা বলেন, উজরা জেয়া ঢাকায় এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেই বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা উঠে আসলে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘তোমাদের দেশে সরকার পরিবর্তনের নির্বাচন কীভাবে হয়?’ উজরা জেয়া বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী।’ তখন প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশেও আগামী নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হবে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকার নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন করে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে পৃথক করা হয়েছে। এগুলো কেন? সুষ্ঠু নির্বাচন চাই বলেই এগুলো করেছি আমি।’
ওই সূত্র দুটির ভাষ্য, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ফর্মুলা থাকলে সেটি নির্বাচন কমিশনকে অবহিত করতে বলেন প্রধানমন্ত্রী। সূত্র দুটি জানায়, যুক্তরাষ্ট্র তাদের চাওয়া অনুযায়ী কমিশনকে ফর্মুলা দিয়েছে বলে জানেন তারা।
দলের তরফ থেকে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, আওয়ামী লীগের এমন এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আগামী নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ফর্মুলা দিতে শুরু করেছেন বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা। পশ্চিমা বিভিন্ন দেশের মডেল নির্বাচন, বিদেশি পর্যবেক্ষক ও বিশেষজ্ঞদের অভিজ্ঞতার আলোকে ফর্মুলা দিয়েছেন পিটার হাস।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিদেশি মডেলসহ দেশি দুটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের মডেলও দিয়েছেন পিটার হাস। এর মধ্যে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য দাবি করে সেই নির্বাচনের ফর্মুলাও দেওয়া হয়েছে বলে কমিশন সূত্র জানিয়েছে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি কর্মকর্তা যারাই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি নিয়ে সরকার ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, আমরা বলেছি আপনাদের কোনো ফর্মুলা থাকলে সেটি নির্বাচন কমিশনকে দিতে পারেন। শেখ হাসিনার সরকার শুধু সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেবে সেটাই বলেনি, বিদেশিদের কাছে ফর্মুলাও চেয়েছে।’